নেত্রকোনার এক সাদাসিধে গ্রামের ছেলে রিপন মিয়া। যিনি একসময় ‘ক্রিঞ্জ’ ভিডিওর জন্য হাসির পাত্র ছিলেন, আজ তিনি বাংলাদেশের কোটি মানুষের কাছে এক ভালোবাসার নাম। তার সরলতা, হাস্যরস এবং জীবনের প্রতি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে, যা শুধু বিনোদন নয়, অনেকের কাছে প্রেরণারও উৎস হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে রিপন মিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১৫ লক্ষাধিক ফলোয়ার, যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীই তাকে চেনে এবং পছন্দ করে। এমনকি অনেকেই বলেন, “এক রিপন মিয়ার জীবন যেন সুখের সুন্দর একটা সংজ্ঞা।”
‘ক্রিঞ্জ’ থেকে শুরু, আজ সবার ভালোবাসার রিপন মিয়া:
২০১৬ সালে এক ব্যর্থ প্রেমের পর রিপনের ভিডিও তৈরির যাত্রা শুরু। তৃতীয় শ্রেণির পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে হতাশ না হয়ে তিনি মোবাইল ফোনে ছোট ছোট ভিডিও বানাতে শুরু করেন।
তার প্রথম ভাইরাল ভিডিওর ডায়লগ ছিল: “তুমি যখন একা থাকবে, আমাকে ফোন দিও, আমরা সারারাত কথা বলবো… আই লাভ ইউ।”
এটা ছিল খুব সাধারণ, কিন্তু তার স্বাভাবিক হাসি এবং সরলতা মানুষের মনে দাগ কাটে।
শুরুতে মানুষ তার ভিডিওকে ‘ক্রিঞ্জ’ বলে হাসলেও ধীরে ধীরে তার অনন্য হাস্যরস এবং গ্রামীণ স্টাইল তাকে জনপ্রিয় করে তোলে।
গ্রামীণ জীবনের সরলতা – জনপ্রিয়তার মূল রহস্য:

রিপনের ভিডিওতে কোনো ফ্যান্সি ক্যামেরা এফেক্ট নেই, নেই গ্ল্যামার। বরং তার ভিডিওতে থাকে—
- গরমে কাঠমিস্ত্রির কাজ,
- সাইকেল চালিয়ে কাজে যাওয়া,
- মাটির চুলায় রান্না করা,
- শহরে গিয়ে উঁচু বিল্ডিং দেখে মুগ্ধ হওয়া,
- অথবা ভাঙা ইংরেজি ও হিন্দি বলার মাধ্যমে দর্শকদের হাসানো।
এমন সাধারণ কিন্তু বাস্তব জীবনের মুহূর্তগুলোই মানুষকে রিপনের ভিডিওর প্রেমে ফেলেছে।
মানুষ কেন রিপনকে ভালোবাসে?
সরলতা ও বাস্তবতা: তার ভিডিও মানুষকে এক বাস্তব সুখের ধারণা দেয়।
গ্রামীণ জীবনের স্বাদ: শহুরে দর্শকরা তার ভিডিওতে গ্রামের গন্ধ পান।
হাস্যরস ও ভাষা: তার ভাঙা ইংরেজি, মজার অঙ্গভঙ্গি এবং অদ্ভুত কথোপকথন মানুষকে হাসায়।
প্রেরণা: “আমি কাঠমিস্ত্রি, দিনে ৫০০ টাকা আয় করি”—এই আত্মনির্ভরতার কথা অনেককে অনুপ্রাণিত করে।
উমেদ ইবনিমুস্তাফা নামে এক নেটিজেন লিখেছেন:
“মনে হয় জীবনের সুখ মানে যদি রিপন মিয়ার মতো সহজ সরল হতো! কোনো গ্ল্যামার নেই, কিন্তু এটাই তো প্রকৃত সুখ।” এই মন্তব্যে লাইক পড়েছে প্রায় ৪০ হাজার!
সংগ্রামের কঠিন পথ:
রিপন মিয়ার জীবন সবসময় সহজ ছিল না। ভাইরাল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তিনি অর্থ উপার্জন করতে পারেননি। তার পেজগুলো হ্যাক হয়ে যায়। একসময় মোবাইল না থাকায় ভিডিও বানানোই বন্ধ করে দেন।
তার নিজের ভাষায়:
“মানুষ আমার ভিডিও দিয়ে টাকা কামিয়েছে, আমি কিছুই পাইনি। এমনকি আমার ভাঙা ঘরে কুকুর ঢুকে যেত।”
২০১৯ সালে কাঠমিস্ত্রির কাজ করেই সংসার চালাতেন। কিন্তু এক মিডিয়া ম্যানেজারের সহযোগিতায় আবারও ভিডিও বানানো শুরু করেন। এখন তিনি নিজের ভিডিও থেকে আয়ও করছেন।
রিপনের নতুন রূপ – ‘Ripon 2.0’
বর্তমানে রিপনের ভিডিওতে আগের মতো প্রেমের ছড়া নেই। তার পরিবর্তে এসেছে জীবনের শিক্ষা ও সামাজিক বার্তা।
- তিনি ভিডিওতে মানুষকে কাজ শিখতে উৎসাহিত করেন।
- নারীদের রান্নার কষ্ট বুঝে সম্মান দেখানোর আহ্বান জানান।
- সাইকেল চালানোর সুবিধা নিয়ে কথা বলেন।
- যৌতুকবিরোধী বার্তা দেন।
এক ভিডিওতে তিনি বলেন: “আমি কাঠমিস্ত্রির কাজ করি, গরমে কষ্ট করি। যারা বেকার আছো, আমার কাছে এসো, আমি শিখিয়ে দেব, দিনে ৫০০ টাকা আয় করবে।”

বিদেশে ঘুরে বেড়ানো এবং নতুন বিনোদন:
সম্প্রতি রিপন নেপাল ভ্রমণে গিয়েছেন এবং সেখান থেকেও ভিডিও দিচ্ছেন। তার ভাঙা ইংরেজি ও হিন্দি বলার ধরণ ভক্তদের কাছে আলাদা আনন্দের উৎস।
তার জনপ্রিয়তা কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো?
- ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক মিলিয়ে তার ফলোয়ার এখন ১৫ লক্ষাধিক।
- তার ভিডিওগুলোর ভিউ কোটি ছাড়িয়েছে।
- নেটিজেনদের কাছে তিনি এখন এক “আইকন অফ সিমপ্লিসিটি”।
রিপন মিয়ার গল্প শেখায়—
সুখ মানে বিলাসিতা নয়।
সাফল্য মানে সহজে হার না মানা।
জীবনকে সরলভাবে উপভোগ করাই প্রকৃত আনন্দ।
আজকের নেটিজেনদের কাছে রিপন মিয়া কেবল বিনোদনের উৎস নন, তিনি গ্রামীণ জীবনের সৌন্দর্য ও সুখের প্রতীক। তাইই সবাই বলে:
“এক রিপন মিয়ার জীবন যেন সুখের সুন্দর একটা সংজ্ঞা।”