বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি নতুন অধ্যায় যুক্ত হলো। আজ মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বিকেল ৫টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপের মাধ্যমে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সকল শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষনেতারা, আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
মুহাম্মদ ইউনূসের কণ্ঠে ঘোষণাপত্র পাঠের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত লাখো মানুষের আবেগাপ্লুত প্রতিক্রিয়া, করতালিতে মুখরিত হয় জাতীয় সংসদ দক্ষিণ প্লাজা। শহীদদের আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি জানিয়ে এ ঘোষণাপত্র যেন গোটা জাতিকে নতুন এক গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্দীপ্ত করল।
প্রধান উপদেষ্টা জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করে বলেন:
“বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সকল শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করছে। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছে। শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা ও আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে সবধরনের আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার অঙ্গীকার করছি।”
ঘোষণাপত্রে আরও উল্লেখ করা হয় যে—
- বিগত ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময়ে সংঘটিত গুম-খুন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠনসহ সব নৃশংস ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা হবে।
- আন্দোলনের সকল শহীদদের আত্মত্যাগকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে আগামী নির্বাচিত সরকারের অধীনে সংবিধানের তফসিলে জুলাই ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত করা হবে।
- ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত ‘ছাত্র-গণ–অভ্যুত্থান ২০২৪’ কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।
ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,
“অবৈধ শেখ হাসিনা সরকারের পতন, ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার অবসান ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জনগণ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীতে ৫ আগস্ট লাখো মানুষের ঢল ঢাকামুখী লংমার্চে পরিণত হলে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য হয়।”
এই ঘোষণা শুধু শেখ হাসিনার পতনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিই দেয়নি, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন সূচনার দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
এ ঘোষণার মাধ্যমে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রতিটি শহীদ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয় বীর’ মর্যাদা পেলেন। শহীদদের পরিবারের জন্য বিশেষ ভাতা, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি আহত যোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করবে বলেও ঘোষণাপত্রে জানানো হয়।
এছাড়া, দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং জাতীয় পর্যায়ে ‘জুলাই অভ্যুত্থান জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠারও ঘোষণা দেওয়া হয়।
জুলাই ঘোষণাপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়—
- ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে।
- ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করেছে।
- শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয় একটি বৈষম্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার।
ঘোষণাপত্র পাঠের পর ছাত্রনেতা এবং রাজনৈতিক নেতারা একে বাংলাদেশের জন্য “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়” হিসেবে আখ্যা দেন। ছাত্রনেতারা বলেন,
“শহীদদের আত্মত্যাগ আজ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেল। আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, ফ্যাসিবাদের শেকড় বাংলাদেশের মাটি থেকে চিরতরে নির্মূল করব।”
রাজনৈতিক নেতারা বলেন,
“এ ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির নতুন দিকনির্দেশনা। জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এটি এক মাইলফলক।”
গত বছরের ৫ আগস্ট কারফিউ ভেঙে লাখো মানুষ ঢাকামুখী লংমার্চ শুরু করে। ঢাকার প্রবেশমুখে ও গণভবনের চারপাশে উত্তাল জনস্রোত যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, তখন শেখ হাসিনা রাতারাতি দেশত্যাগে বাধ্য হন। পরদিন রাষ্ট্রপতির ঘোষণার মাধ্যমে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বভার নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস রচিত হয়।
আজকের এ ঘোষণাপত্র শুধুমাত্র শহীদদের স্বীকৃতিই নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন সূচনা। জাতি আজ অঙ্গীকার করেছে— “ফ্যাসিবাদমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ব।”