ডেস্ক রিপোর্ট | বাংলা নিউজ স্টেশন | ৭ আগস্ট ২০২৫, গাজীপুর

গাজীপুর মহানগরের ব্যস্ততম এলাকা চান্দনা চৌরাস্তার ঠিক সামনে, মসজিদ মার্কেটের পাশে ঘটে গেলো এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। সাহসী ও সৎ সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে (৩৮) প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এই নির্মম ঘটনাটি শুধু একজন সাংবাদিককে হত্যা নয়, বরং পুরো গণমাধ্যমকেই ভয় দেখানোর একটি নগ্ন প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নিহত আসাদুজ্জামান তুহিন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিলেন। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এবং পরিবার নিয়ে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বসবাস করতেন।
বিকেলের লাইভ: চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ
ঘটনার সূত্রপাত হয় বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) বিকেলে। সাংবাদিক তুহিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ফেসবুক লাইভ করেন, যেখানে তিনি গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ফুটপাত দখল ও দোকান থেকে চাঁদাবাজির বিষয়ে সরাসরি প্রতিবাদ জানান। তিনি বিভিন্ন চাঁদাবাজ চক্র ও অসাধু প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন এবং ভিডিও প্রমাণসহ সেই তথ্য লাইভে তুলে ধরেন।
এরপর সন্ধ্যা ৮টার কিছু আগে তুহিন তার ফেসবুক প্রোফাইলে আরেকটি পোস্ট দেন— “যেমন খুশি তেমন রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য: গাজীপুর চৌরাস্তা।” এই পোস্টেও স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিলো শহরের শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ড ও প্রশাসনের উদাসীনতার বিরুদ্ধে।
রাত সোয়া ৮টার দিকে সাংবাদিক তুহিন প্রতিদিনের মতোই মসজিদ মার্কেটের পাশে একটি চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলেন। হঠাৎ করেই কয়েকজন মুখোশধারী দুর্বৃত্ত তাকে ঘিরে ধরে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। চায়ের দোকানের সামনে জনসমাগম থাকা সত্ত্বেও হামলাকারীরা নির্দ্বিধায় গলা কেটে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
বাসন থানার ওসি শাহীন খান জানান, “ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। এই হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে এবং খুনিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।”
সাংবাদিক সমাজের প্রতিক্রিয়া: শোক ও ক্ষোভ
এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে সাংবাদিক সমাজে নেমে এসেছে গভীর শোক ও ক্ষোভ। সাংবাদিকরা মনে করছেন, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মুখ খোলার কারণেই তাকে প্রাণ দিতে হলো। এটি শুধু তুহিনের হত্যাকাণ্ড নয়, বরং সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলার একটি চরম বার্তা।
দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ-এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “তুহিন একজন সাহসী, নিষ্ঠাবান ও সত্যবাদী সাংবাদিক ছিলেন। তার মৃত্যু আমাদের গণমাধ্যমে অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার দাবি করছি।”
গণমাধ্যম কর্মীদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—গণতান্ত্রিক দেশে একজন সাংবাদিক যদি প্রকাশ্যে এমন হত্যার শিকার হন, তবে বাকিরা কতটা নিরাপদ?
একই দিনে আরেক হামলা: সাংবাদিক আনোয়ারের উপর নির্মম নির্যাতন
তুহিন হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে আসে আরেক সাংবাদিক নির্যাতনের খবর। গাজীপুর সদর থানার সামনে, প্রকাশ্যে ইট দিয়ে পা থেতলে দেওয়া হয় সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সৌরভকে। ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে এই নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। আনোয়ার বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি, তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
এই দুটি ঘটনায় পুরো সাংবাদিক মহল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো নড়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন, এই হামলাগুলো বিচ্ছিন্ন নয় বরং পূর্বপরিকল্পিত, এবং এতে প্রভাবশালীদের মদদ রয়েছে।
রাষ্ট্র ও প্রশাসনের ভূমিকা: প্রশ্নের মুখে নিরাপত্তা
এই হত্যাকাণ্ড প্রশাসনের দক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। যদি একজন সাংবাদিক চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে প্রাণ হারান, তবে সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা কোথায়?
মানবাধিকার সংগঠন, প্রেস কাউন্সিল ও সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো সরকারের কাছে স্পষ্ট দাবি জানিয়েছে:
- ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার
- সাংবাদিকদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
- গাজীপুরে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান
- ভিকটিম সাংবাদিকদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা
আসাদুজ্জামান তুহিনের জীবন ছিলো সত্য ও সাহসিকতার প্রতীক। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, সাংবাদিকতা মানে শুধু সংবাদ লেখা নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। তাঁর মৃত্যু আমাদের দুঃখের হলেও, তার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়নি—বরং আরও হাজার কণ্ঠ জাগবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
আসাদুজ্জামান তুহিনকে আমাদের শ্রদ্ধা, তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। আমিন।