জীবনের প্রথম যাত্রা, অথচ গন্তব্য হল চিরবিদায়
স্নেহা চক্রবর্তী—একজন স্বপ্নবাজ কিশোরী। সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সুবিপ্রবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়ে ফিরছিলেন বাড়ি। জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো সেদিন সকালে। বাবা বিপুল চক্রবর্তী নিজ হাতে মেয়েকে নিয়ে যান ক্যাম্পাসে। ভর্তি কার্যক্রম শেষে মেয়েকে তুলে দেন একটি অটোরিকশায়। বাবা তখন নিজের কর্মস্থলে যাচ্ছেন। মনে শান্তি—মেয়ে ভর্তি হলো, পরিবারে খুশির হাওয়া বইবে।
কিন্তু খুশির সেই মুহূর্ত মাত্র ১০ মিনিট স্থায়ী হলো। বাহাদুরপুর এলাকায় বাস ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে চিরতরে নিভে গেলো স্নেহার জীবন প্রদীপ।
বাড়ির খুশি মুহূর্তেই হয়ে গেল শোক
বিকেলে সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে শোকাবহ দৃশ্য। স্নেহার নিথর দেহের পাশে মা জয়তী চক্রবর্তী আর ছোট ভাই সূর্য চক্রবর্তীর আহাজারি থামছে না। ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “মা, তুমি কাইন্দ না। কিচ্ছু অইছে না, আমরা আপারে নিয়া ঢাকা যাইমু, সব ঠিক অইজিব…” কিন্তু বাস্তবতার নিষ্ঠুর থাবা এত সহজে ছাড়ে না।
স্নেহার বাবা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। পুরো পরিবার তাঁর স্বপ্নঘেরা মেয়েকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছিল। জয়কলস গ্রামে বাড়ি হলেও লেখাপড়ার সুবিধার জন্য পরিবার নিয়ে শহরে থাকতেন। আজ সেই শহরের মর্গেই মেয়ে শুয়ে আছে নিথর হয়ে।
জন্মদিনে সহপাঠীদের ভালোবাসা, ফিরতি পথে মৃত্যু
একই দুর্ঘটনায় নিহত হন আফসানা জাহান খুশি নামের সুনামগঞ্জ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের আরেক শিক্ষার্থী। সেদিন ছিল তাঁর ১৯তম জন্মদিন। সকালবেলায় ক্যাম্পাসে গিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে জন্মদিন উদ্যাপন করেন। হাসিখুশি মুখে উপহার নিয়ে ফিরছিলেন বাড়ি। কিন্তু কে জানত সেই ব্যাগভর্তি উপহারগুলো আর কখনো খুলে দেখা হবে না!
পরে তাঁর ব্যাগে সহপাঠীদের দেওয়া নানা উপহার পাওয়া যায়। কিছুতে লেখা, “শুভ জন্মদিন খুশি।” সেই শুভেচ্ছা আজ যেন বিষাদে মোড়ানো স্মৃতি। বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য দেলোয়ার হোসেন বারবার বলছিলেন, “হায়রে মা, জন্মদিনে এত খুশি হইছ, কিন্তু বাড়িতে তো আর আসলি না…”
দুর্ঘটনার পেছনের দায় কার?
সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কটি এখন মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। যাত্রীবাহী বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অটোরিকশাটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তিনজনের—স্নেহা, আফসানা এবং আরেক যাত্রী শফিকুল ইসলামের। আহত হন আরও দুজন।
প্রত্যক্ষদর্শী বাসযাত্রী ছোটন দাস জানান, হঠাৎ করে বাসটি কিছু একটা ঠেকেছে বলে মনে হয়। চালক ও সহকারী বাস রেখে পালিয়ে যান।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাকির হোসেন জানান, “বাসটি জব্দ করা হয়েছে। চালক ও সহকারীকে আটকের চেষ্টা চলছে।” কিন্তু এখানেই শেষ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, এসব দুর্ঘটনার দায়ভার কেউ নিচ্ছে কি?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ও করণীয়
সুবিপ্রবির প্রক্টর শেখ আবদুল লতিফ বলেন, “স্নেহা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সকালে ভর্তি হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা তাঁকে হারালাম। কীভাবে সান্ত্বনা দেব পরিবারকে?”
তিনি আরও বলেন, “এই সড়কে অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি—সবই চলছে। সংশ্লিষ্টদের এখনই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এমন মৃত্যু থামবে না।”
শেষ মুহূর্তে উপহার আর স্বপ্ন—সবই ইতিহাস
স্নেহা ও আফসানার মৃত্যু কেবল দুটি পরিবারের নয়, একটি সমাজের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পথ, যা হওয়ার কথা ছিল নিরাপদ—তা হয়ে উঠেছে মৃত্যু ফাঁদ।
জন্মদিনের উপহার, ভর্তি শেষে বাবার মুখের হাসি—এই সবকিছু আজ কেবল কান্নার গল্প। স্কুল ব্যাগে করে যে স্বপ্নগুলো ফেরার কথা ছিল, তা আর ঘরে ফিরল না। ফিরল কেবল শোক আর অপূরণীয় ক্ষতির খবর।