লুট হওয়া অস্ত্রের গুলিতে মৃত্যু, ‘শহীদ’ বানিয়ে চলছে ‘জুলাই বাণিজ্য’?

📅 প্রকাশিত: ৮ আগস্ট ২০২৫

✍️ রিপোর্ট: বাংলা নিউজ স্টেশন ডেস্ক

bangla news station 1120

“জুলাই অভ্যুত্থান”–এ গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ২২ বছর বয়সী ইমতিয়াজ হোসেন। তাঁকে ‘শহীদ’ ঘোষণা করে সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশও হয়েছে। কিন্তু ঘটনার এক বছর পেরিয়ে প্রশ্ন উঠছে—ইমতিয়াজ আসলেই শহীদ ছিলেন, না কি একটি দুর্ঘটনার বলি?

নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার হাটপুকুরিয়া ঘাটলাবাগ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ইমতিয়াজ হোসেন গত বছরের ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন এবং পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর পিতা মো. হাবিবুর রহমানের আবেদনের ভিত্তিতে তাঁকে ‘জুলাই শহীদ’ হিসেবে গেজেটভুক্ত করা হয়।

ন্তু স্থানীয়দের মতে, ইমতিয়াজ কোনো আন্দোলনে অংশ নেননি, বরং থানা থেকে লুট করা অস্ত্র থেকেই দুর্ঘটনাবশত গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। অভিযোগ উঠেছে, এই ঘটনার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে মামলা-বাণিজ্য, প্রভাব খাটানো ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জটিল নেপথ্য কাহিনি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের খবরে চাটখিল পৌরবাজারে আনন্দ মিছিল শুরু হয়।
মিছিলের একপর্যায়ে চাটখিল থানায় হামলা ও সরকারি অস্ত্র লুট হয়।
সেই ঘটনার কিছুক্ষণ পরই ইমতিয়াজ গুলিবিদ্ধ হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন।

কিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যুর পর শুরু হয় নানা বিতর্ক।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ইমতিয়াজ নিজেই বলেছিলেন—”আমার বন্ধুরা আমাকে গুলি করেছে।”
অনেকের মতে, থানা থেকে লুট করা অস্ত্র নিজের কোমরে রাখার সময় দুর্ঘটনাবশত গুলি বের হয়ে যায়, যা তাঁর পেটে বিদ্ধ হয়।

‘শহীদ’ ঘোষণার পেছনে রাজনীতি ও আর্থিক সুবিধা?

মতিয়াজের মৃত্যুর প্রায় দুই মাস পর, ২৯ সেপ্টেম্বর তাঁর বাবা ‘জুলাই শহীদ’ স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেন এবং
২০২৫ সালের ২১ মে ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মামলার ভয় দেখিয়ে তিনি অর্ধ কোটি টাকার বেশি অর্থ আদায় করেছেন।
এছাড়াও ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকেও প্রায় ১৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠে এসেছে।

ছাত্রদের প্রতিবাদ: শহীদের অপমান নয় কি?

নোয়াখালী সরকারি কলেজের একাধিক ছাত্র প্রতিনিধি বিষয়টি ঘিরে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
তাদের দাবি—ইমতিয়াজ আন্দোলনের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না, তিনি ছিলেন কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি ম্যান।

একজন ছাত্র নেতা বলেন:

“যেভাবে কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন, ঠিক তেমনি ইমতিয়াজও কোনো আন্দোলনে না থেকেও শহীদ গেজেটভুক্ত হয়েছেন।”

বাবার বক্তব্য ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া

ইমতিয়াজের বাবা হাবিবুর রহমান দাবি করেন:

“আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পেটে গুলি লেগেছে—এটা দুর্ঘটনা নয়। আমি হত্যার বিচার চাই।”

অন্যদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতা বলেন:

“হাবিবুর রহমান বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ছেলেকে শহীদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।”

এমনকি তিনি নাকি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ছেলেকে হত্যার অভিযোগ এনেছেন, যদিও ঘটনার সময় অধিকাংশ নেতাই এলাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন।

প্রশাসনের অবস্থান: তদন্তাধীন ও স্থগিত সুবিধা

নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ জানান:

“বিষয়টি তদন্তাধীন। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইমতিয়াজের পরিবারকে সব ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

মূল প্রশ্নগুলো যেগুলোর উত্তর দরকার:

  • ইমতিয়াজ আন্দোলনের সঙ্গে কতটুকু সম্পৃক্ত ছিলেন?
  • তাঁর মৃত্যু দুর্ঘটনা না পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?
  • ‘শহীদ’ ঘোষণার পেছনে কারা কতটা প্রভাবিত হয়েছেন?
  • মামলাভিত্তিক চাঁদাবাজির অভিযোগ কতটা সত্য?
  • গেজেট বাতিলের প্রক্রিয়া প্রশাসন কবে থেকে শুরু করবে?

ইমতিয়াজ হোসেনের মৃত্যু একটি জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের জটিল অধ্যায় হয়ে উঠেছে।
একদিকে পরিবারের দাবি—তিনি শহীদ, অন্যদিকে ছাত্র ও স্থানীয়দের অভিযোগ—এটি ‘মিথ্যা শহীদের’ গল্প।
সরকারি তদন্তে যদি সত্যিই প্রমাণিত হয় যে তাঁর মৃত্যু ছিল দুর্ঘটনাজনিত এবং গেজেটভুক্তি ছিল প্রভাবিত, তবে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে আরও একটি ভুয়া শহীদ গেজেট হয়ে থাকবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *