মারজিনা আক্তারের বুকফাটা আর্তনাদ, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ স্বামীর রক্তের বিনিময়ে আজ তিনি একা, নিঃস্ব এবং অসহায়। স্বামী হারানোর বেদনা, শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া এবং সমাজের অবহেলা_সব মিলিয়ে তার জীবন হয়ে উঠেছে এক অন্ধকার অধ্যায়।
স্বামী হারানোর পর ভেঙে পড়া এক নারী
শনিবার (২ আগস্ট) সকালে দৈনিক নয়া দিগন্তের সঙ্গে কথা বলার সময় শহীদ জোবায়েরের স্ত্রী মারজিনা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন,
“বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমার স্বামী জীবন দিলেন। আজ সেই রক্তের বিনিময়ে কেউ পদ পেল, কেউ সম্মান পেল। কিন্তু আমি? স্বামী হারালাম, শ্বশুরবাড়ির ঘর হারালাম, স্বর্ণালঙ্কার হারালাম, সুখের স্বপ্নও হারালাম। আমি তো সব হারিয়েছি। নিঃস্ব হয়ে গেছি।”
বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বিধবা
মারজিনা আক্তারের বিয়ে হয় ২০২৩ সালের ২৩ জুন, ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শহীদ জোবায়ের আহম্মেদের সঙ্গে।
বিয়ের পর কয়েক মাস সুখেই কাটছিল তাদের জীবন। জোবায়ের মোবাইল যন্ত্রাংশের ব্যবসা করতেন, পরিশ্রমী ছিলেন, স্বপ্ন ছিল সংসারটিকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলার। কিন্তু সেই স্বপ্নের সবটুকু ভেঙে চুরমার করে দেয় জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলন।
২০২৪ সালের ২০ জুলাই, ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে কলতাপাড়ায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন জোবায়ের আহম্মেদ। সেদিন স্ত্রীর কাছ থেকে মাত্র ৫০ টাকা নিয়ে তিনি আন্দোলনে বের হয়েছিলেন। সেই দিনই স্ত্রীর চোখের সামনে স্বামীর লাশে ঢেকে যায় তার ভবিষ্যৎ।
শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ
জোবায়েরের মৃত্যুর পর শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন মারজিনা। অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে বাবার বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জের বৃ-পাচাশী গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে তিনি স্বামীর বাড়িতে ফেরেন, কিন্তু সেখানে তাকে গ্রহণ করা হয়নি।
মারজিনা বলেন,
“আমি শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেলে তারা খারাপ ব্যবহার করে। স্বামীর রুহের শান্তির জন্য মিলাদে গিয়েছিলাম, সেখানেও অপমান করল। বাড়ি থেকে বের করে দিল। আমার মা-কে বলল, সবকিছু নিয়ে চলে যান, আর কোনোদিন আসবেন না।”
তিনি আরো অভিযোগ করেন, বিয়ের সময় পাওয়া স্বর্ণালঙ্কার সবই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নিয়ে নিয়েছে। সেই টাকায় ব্যবসা শুরু করেছিলেন জোবায়ের। দোকানের সব মালামাল, স্বামীর সম্পদ সবই এখন শ্বশুরবাড়ির দখলে।
“আমার হাতে শুধু স্বামীর বিয়ের পাঞ্জাবি, একটা টি-শার্ট আর একটা টাওয়েল। এগুলোই তার গন্ধ নেওয়ার একমাত্র সম্বল।”
মারজিনা এখন তার বাবার বাড়িতে থাকেন। তিনি বলেন,
“আমি শুনেছি সরকার অনুদান দিচ্ছে, কিন্তু কেউ আমার খবর নেয়নি। আমি তো শহীদ জোবায়েরের স্ত্রী! আমার স্বামীকে হারিয়েছি, তার ঘরও হারিয়েছি। আমার বেঁচে থাকার আর কোনো শক্তি নেই।”
মারজিনার বাবা মো. শহীদুল্লাহ জানান,
“মেয়েটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। একেক ডাক্তারের কাছে নিয়ে একেকভাবে চিকিৎসা করেছি। প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমার তিন মেয়ে আর দুই ছেলের মধ্যে মারজিনা চতুর্থ। সবাই মিলে তাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে চেষ্টা করেছি।”
শাশুড়ি মারজিনার মা মোছা. মনোয়ারা খাতুন অভিযোগ করেন,
“৪০ দিনের মিলাদে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে গিয়েও অপমানিত হতে হলো। জোবায়েরের শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের বের করে দেয়। কখনো বলেনি, তোমার জামাই নেই, তুমি তো আছো—এখানে থাকো। বরং যা আছে নিয়ে চলে যাও—এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে হলো।”
অন্যদিকে, শ্বশুর আনোয়ার উদ্দিন বলেন,
“আমি ছেলে হারিয়েছি। পুত্রবধূকে রাখতে হলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা দরকার। আমি তাদের বলেছি, ওর মোহরানা দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে বিয়েশাদি হলে সাহায্য করব। কিন্তু সে আমার ছেলের পাসপোর্ট, ভোটার আইডি চায়—এগুলো নিয়ে কী করবে?”
জোবায়ের আহম্মেদ ছিলেন পরিশ্রমী যুবক। তিনি শম্ভুগঞ্জে দোকান ভাড়া নিয়ে পুরাতন মোবাইল কিনে যন্ত্রাংশ বিক্রি করতেন। ব্যবসা ভালো চলতে শুরু করলে ভারত ও চীন থেকে মোবাইলের যন্ত্রাংশ আমদানি করতেন। তার আয়ে সংসার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে প্রতিবার তিনি দোকান বন্ধ রেখে ময়মনসিংহে যেতেন। শেষবারও তাই করেছিলেন। কিন্তু ফিরলেন লাশ হয়ে।
মারজিনা আক্তারের কথায় উঠে আসে এক বেদনাদায়ক বাস্তবতা:
“আমার স্বামীর রক্তের বিনিময়ে কেউ ক্ষমতা পেল, পদ পেল। কিন্তু আমি? আমি তো শুধু অন্ধকার আর অভাব পেলাম। শহীদ পরিবারের এই অবহেলা কি ন্যায়সঙ্গত?”
আজও মারজিনা আক্তার স্বামীর স্মৃতিতে বাঁচেন। বিয়ের পাঞ্জাবি বুকে চেপে তিনি স্বামীর গন্ধ নেন। সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন কোনো সহায়তার আশায়। তার বুকফাটা আকুতি—”স্বামী হারালাম, ঘর হারালাম, সম্মানও হারালাম। আমি তো শুধু নিঃস্ব এক শহীদের স্ত্রী হয়ে বেঁচে আছি!”



