রাজশাহী | শুক্রবার, ১৫ আগস্ট ২০২৫

রাজশাহীতে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে যেখানে একই পরিবারের চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতরা হলেন মিনারুল ইসলাম (৩০), তার স্ত্রী মনিরা বেগম (২৮), ছেলে মাহিম (১৩) ও দেড় বছরের মেয়ে মিথিলা।
ঘটনার বিবরণ
শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে স্থানীয়রা মিনারুলের বাড়িতে কোনো সাড়া না পেয়ে খোঁজ নিতে যান। ঘরে ঢুকে তারা দেখেন— মিনারুল ফ্যানের সাথে ঝুলছেন, ছেলের মরদেহ বিছানায়, আর স্ত্রী ও মেয়ের মরদেহ অন্য ঘরে পড়ে আছে। সাথে সাথে পুলিশে খবর দেওয়া হয়।
মতিহার থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে, মিনারুল প্রথমে স্ত্রীকে ওড়না দিয়ে এবং মেয়েকে গামছা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। এরপর ছেলেকে একইভাবে হত্যা করে নিজে ফাঁস নেন।
চিরকুটে লেখা শেষ কথা
ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া চিরকুটে মিনারুল লিখেছেন:
“আমি নিজ হাতে সবাইকে মারলাম এই কারণে যে, আমি একা যদি মরে যাই, তাহলে আমার স্ত্রী-সন্তান কার কাছে থাকবে? কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া তারা কিছুই পাবে না। আমি মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়া-দাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারলাম না। আমাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো হলো। কারো কাছে আর কিছু চাইতে হবে না।”
এই লেখার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, অর্থনৈতিক সংকট এবং হতাশাই তাকে এমন চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।
স্থানীয়রা জানান, মিনারুল একসময় জুয়ায় আসক্ত ছিলেন এবং মাদকও গ্রহণ করতেন। এর ফলে বিপুল ঋণের বোঝা তৈরি হয়। কিছুদিন আগে বাবার জমি বিক্রি করে আংশিক ঋণ শোধ করলেও পরিবারের দৈনন্দিন খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না। অনেক সময় খাবারের অভাবে দিন কাটছিল।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র গাজিউর রহমান বলেন,
“আমরা ঘটনাস্থল থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলামত সংগ্রহ করেছি। সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত চলছে। অর্থনৈতিক সংকট ও পারিবারিক হতাশা ঘটনার মূল কারণ বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।”
প্রতিবেশীরা জানায়, মিনারুল সাধারণত শান্ত স্বভাবের ছিলেন, কিন্তু গত কয়েক মাসে তাকে হতাশাগ্রস্ত দেখা যেত। তিনি মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতেন এবং বলতেন, “এভাবে আর বাঁচা যাবে না।” অনেকেই মনে করেন, সামাজিক সহযোগিতার অভাব এবং আর্থিক চাপে এ ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ দারিদ্র্য, ঋণ, বেকারত্ব, পারিবারিক বিরোধ ও মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক সচেতনতা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়া এ ধরণের ঘটনা থামানো সম্ভব নয়।
প্রতিরোধের উপায়
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য।
- পারিবারিক সহযোগিতা: পরিবারের সদস্যদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা।
- মানসিক স্বাস্থ্যসেবা: হতাশা বা বিষণ্নতায় ভোগা ব্যক্তিকে দ্রুত কাউন্সেলিংয়ে পাঠানো।
- অর্থনৈতিক সহায়তা: দারিদ্র্য ও ঋণ সংকটে পড়া পরিবারের জন্য সরকারি সহায়তা।
- সামাজিক নজরদারি: প্রতিবেশী বা আত্মীয়রা যদি কারো মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখেন, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।
রাজশাহীর এই ঘটনা শুধু একটি পরিবার নয়— সমগ্র সমাজের জন্য সতর্কবার্তা। অর্থনৈতিক সংকট ও মানসিক হতাশা কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তা এ ঘটনায় স্পষ্ট। এখন সময় এসেছে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর, যাতে আর কোনো পরিবার এভাবে নিঃশেষ না হয়।