বাবাকে হারিয়ে স্কুল ছাড়লেও সহমর্মিতায় আবারও পড়াশোনায় ফিরল জয় রবি দাস

বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

joy rabi das back to school rangpur
জয় রবি দাস

রংপুরের তারাগঞ্জের কিশোর জয় রবি দাস নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। বাবাকে হারিয়ে জুতা সেলাইয়ের চৌকিতে বসে সংসারের হাল ধরতে হলেও, মানুষের সহমর্মিতা ও সহায়তায় সে আবার স্কুলে ফিরেছে। মাত্র ১৪ বছরের এই কিশোরের কাঁধে এখন বইয়ের ব্যাগ—স্বপ্ন বড় হয়ে আইনজীবী হওয়ার।

বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫) এ তথ্য জানা যায়।

তারাগঞ্জ বাজারের নতুন চৌপথী বাসস্ট্যান্ড থেকে অগ্রণী ব্যাংক মোড় পর্যন্ত এলাকায় একটি ছোট চৌকিতে বসে জুতা সেলাই করতেন জয় রবি দাসের বাবা রূপলাল রবিদাস। পরিবার চালানোর একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। কিন্তু গত ৯ আগস্ট গণপিটুনিতে চোর সন্দেহে নিহত হন রূপলাল ও তার ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লাল রবিদাস।

হঠাৎ করেই বাবাহীন সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে কিশোর জয়ের কাঁধে। নবম শ্রেণির ছাত্র জয়কে পড়াশোনা ছেড়ে বাবার পেশায় নেমে সংসারের খরচ চালাতে হয়। প্রতিদিন ফুটপাতে বসে জুতা সেলাই করতে করতে কিশোর বয়সেই বুঝতে হয় জীবনের কঠিন বাস্তবতা।

গণমাধ্যমে জয় ও তার পরিবারের খবর প্রকাশ হলে সহানুভূতির হাত বাড়ান অনেকেই। স্থানীয় প্রশাসনও এগিয়ে আসে। উপজেলা প্রশাসন এক লাখ টাকা সহায়তা দেয়। বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আর্থিক সহায়তা করে।

Ad Page

তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল রানা জানান, পরিবারের পাশে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। রূপলালের বড় মেয়ে নুপুর দাসের জন্য একটি চাকরি ও বাজারে দোকানঘর করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া জয় ও তার ছোট বোনের পড়াশোনা যাতে বন্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

আবার নতুন করে স্কুলে ফেরা জয় এখন তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে নিয়মিত ক্লাস করছে। বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার হলেও প্রতিদিন স্কুলে যাচ্ছে সে।

জয় জানায়—
“প্রথমদিন বাবার আসনে বসে কাজ করতে গিয়ে বুক ফেটে কান্না এসেছিল, কিন্তু কাঁদতে পারিনি। এখন স্কুলে ফিরেছি, সবাই সাহায্য করছে। আমি বাবার স্বপ্ন পূরণে বড় হয়ে আইনজীবী হতে চাই।”

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু মুসা বলেন—
“জয় খুব মেধাবী ছাত্র। বাবাকে হারিয়ে সে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। তাকে রাস্তায় জুতা সেলাই করতে দেখে খুব খারাপ লেগেছিল। এখন আবার নিয়মিত ক্লাস করছে, আমরা সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছি।”

গত ৯ আগস্ট রাত সাড়ে ৮টার দিকে রূপলাল ও তার ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লালকে স্থানীয়রা চোর সন্দেহে আটক করে। পরে তাদের মারধর করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে রূপলাল মারা যান। পরদিন প্রদীপ লালও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

এরপর নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে তারাগঞ্জ থানায় ৫০০–৭০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার অগ্রগতিতে এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

সহমর্মিতা ও মানবিক সহায়তায় স্কুলে ফেরা জয় এখন ভিন্ন মানুষ। জুতা সেলাইয়ের বদলে বই-খাতা হাতে নিয়ে আবারো তার স্বপ্নের পথে হাঁটছে সে। বাবার স্মৃতি বুকে নিয়ে সে বিশ্বাস করে, একদিন আইনজীবী হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবে।

এই কিশোরের জীবন কাহিনি সমাজের সামনে এক অনন্য দৃষ্টান্ত—দুঃখ ও কষ্টকে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক হয়ে উঠেছে সে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *